২০৩৪ বিশ্বকাপে ভাসমান স্টেডিয়াম! সৌদির নিয়োম প্রকল্প নিয়ে ফাঁস হলো চাঞ্চল্যকর তথ্য
![]() |
| ছবি: সংগৃহীত |
ইন্টারনেট এমন এক জায়গা, যেখানে কোনো ধারণা বা নকশা মুহূর্তেই বৈশ্বিক আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। ২০২৫ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে এক ভিডিও ঝড় তোলে এক্স (X), টিকটক ও ইউটিউবে। সেখানে দেখা যায়—মরুভূমির আকাশে ভাসমান এক উজ্জ্বল ফুটবল স্টেডিয়াম, যেন ভবিষ্যতের কোনো শহরের অংশ। দাবি করা হচ্ছিল, এটি সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ নগর প্রকল্প নিয়োম: দ্য লাইন–এর অন্তর্ভুক্ত “নিয়োম স্কাই স্টেডিয়াম”, যা নাকি ২০৩৪ ফিফা বিশ্বকাপে ব্যবহৃত হবে।
দেখতে যেন বাস্তবের সীমা ছাড়ানো কল্পনা—কিন্তু সত্য একেবারেই ভিন্ন।
সত্য: নিয়োমে স্টেডিয়াম হবে, কিন্তু তা ভাসমান নয়
সৌদি আরবের ২০৩৪ বিশ্বকাপের সরকারি প্রস্তাবনায় মোট ১৫টি স্টেডিয়ামের নাম উল্লেখ আছে—রিয়াদ, জেদ্দা, আল খোবার, আবহা এবং নিয়োমে। এর একটি হলো নিয়োম স্টেডিয়াম, যা বর্ণনা করা হয়েছে “ভূমি থেকে ৩৫০ মিটারেরও বেশি উচ্চতায়, দ্য লাইনের ভেতরে অবস্থিত।”
এই “দ্য লাইনের ভেতরে” কথাটিই বিভ্রান্তির মূল কারণ।
স্টেডিয়ামটি কোনো টাওয়ারের মাথায় বা আকাশে ভাসমান অবস্থায় থাকবে না। এটি তৈরি হবে দ্য লাইনের বিশাল বহুতল কাঠামোর অভ্যন্তরে, যেখানে শহরের বিভিন্ন অংশ একাধিক স্তরে গঠিত হবে। নিয়োম স্টেডিয়ামটি থাকবে চতুর্থ ও পঞ্চম স্তরে—অর্থাৎ এটি উচ্চতায় অনেক ওপরে হলেও সম্পূর্ণ আবদ্ধ ও স্থির একটি স্থাপনা।
ইএসপিএন (ESPN) জানিয়েছে, “নিয়োমে পরিকল্পিত স্টেডিয়ামটি প্রায় এক বছর ধরে ফিফা ২০৩৪ বিশ্বকাপের জন্য অনুমোদিত ১৫টি ভেন্যুর তালিকায় রয়েছে। এটি ৩৫০ মিটার ওপরে হবে, কারণ এটি দ্য লাইনের অংশ হিসেবে নির্মিত হবে—যা এক স্মার্ট, পরিবেশবান্ধব শহর হিসেবে ২০৪৫ সালের মধ্যে ১০০ মাইল জুড়ে বিস্তৃত হবে এবং সম্পূর্ণভাবে নবায়নযোগ্য শক্তিতে চালিত হবে।”
প্রায় ৪৬,০০০ দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই স্টেডিয়ামকে ঘিরে থাকবে হোটেল, অ্যাপার্টমেন্ট, ক্রীড়া ও ওয়েলনেস জোন এবং বৈদ্যুতিক পরিবহন ব্যবস্থা। নির্মাণ শুরু হওয়ার কথা ২০২৭ সালে, আর শেষ হওয়ার সম্ভাবনা ২০৩২ থেকে ২০৩৯ সালের মধ্যে। তবে দ্য লাইন প্রকল্পটি এখনো পরিকল্পনার প্রাথমিক পর্যায়েই আছে।
মিথ্যা: ভাইরাল “ভাসমান স্টেডিয়াম” ভিডিও আসলে এআই–নির্মিত
ইন্টারনেটে যেসব ভিডিওতে মরুভূমির উপরে আলোকিত স্টেডিয়াম দেখা যাচ্ছে, সেগুলো সরকারি নয়। এগুলো তৈরি করেছে এআই শিল্পী ও সিজিআই (CGI) ডিজাইন পেজগুলো, যারা Midjourney এবং Unreal Engine–এর মতো সফটওয়্যার ব্যবহার করে নিয়োমের ধারণাকে অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করেছে।
স্থাপত্য বিশেষজ্ঞরা এসব ভিডিওর কৃত্রিম দিকগুলো সহজেই শনাক্ত করেছেন—অবাস্তব আলোছায়া, একরকমভাবে বারবার নড়াচড়া করা দর্শকসারি, আর এমন ক্যামেরা মুভমেন্ট যা বাস্তবে সম্ভব নয়।
নিয়োমের সরকারি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলো এসব ভিডিও নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, আর সৌদি সরকার বা ফিফাও কখনো এগুলো প্রকাশ বা অনুমোদন করেনি। সাংবাদিক ও স্থপতিরা নিশ্চিত করেছেন—সরকারি বিশ্বকাপ বিড বা নিয়োমের যাচাইকৃত কোনো নথিতেই এই ভিডিও বা রেন্ডার নেই।
তথ্য বনাম গুজব
অনলাইন জগতে ছড়িয়ে পড়া অনেক দাবি বাস্তব ও কল্পনার সীমানা মুছে দিয়েছে।
সৌদি আরব আকাশে ভাসমান স্টেডিয়াম নির্মাণ করছে—এ দাবি সম্পূর্ণ ভুল। সরকারি নথি স্পষ্টভাবে জানায়, স্টেডিয়ামটি নির্মিত হবে দ্য লাইনের ভেতরে, উপরে নয়।
ভাইরাল ভিডিওগুলো বাস্তব নির্মাণচিত্র নয়, বরং এআই–তৈরি দৃশ্য। কেউ কেউ দাবি করেছিলেন, সৌদি কর্মকর্তারা এসব রেন্ডার প্রকাশ করেছেন, কিন্তু এমন কোনো সরকারি ঘোষণা কখনো দেওয়া হয়নি। আর প্রকল্পের নির্মাণ কাজও এখনো শুরু হয়নি—এটি এখনো পরিকল্পনা পর্যায়ে।
বৃহত্তর প্রেক্ষাপট
সৌদি আরবের ২০৩৪ বিশ্বকাপ আয়োজন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের ভিশন ২০৩০–এর অংশ, যার লক্ষ্য দেশটিকে বিশ্বমানের ক্রীড়া, প্রযুক্তি ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। দ্য লাইন, কিদ্দিয়া ও নিউ মুরাব্বা–এর মতো প্রকল্পগুলো সেই ভবিষ্যতমুখী স্বপ্নের প্রতীক।
তবে এইসব মেগা প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনাও প্রবল। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, নিয়োম নির্মাণের কারণে বহু মানুষকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছে, কিছু উপজাতিকে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়েছে, এবং শ্রমিকদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে।
তাই অনলাইনে দেখা “আকাশে ভাসমান স্টেডিয়াম”-এর ঝলমলে ছবির পেছনে রয়েছে ভিন্ন এক বাস্তবতা—যেখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রযুক্তি, স্থাপত্য উদ্ভাবন ও মানবিক প্রশ্ন একসাথে মিশে গেছে।
সৌদি আরবের কথিত “আকাশে ভাসমান স্টেডিয়াম” আসলে ডিজিটাল কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। বাস্তবে ২০৩৪ বিশ্বকাপের জন্য পরিকল্পিত নিয়োম স্টেডিয়াম নির্মিত হবে দ্য লাইনের ভেতরে, মাটির ওপরে নয়।
ভাইরাল ভিডিওগুলো কেবল ডিজিটাল বিভ্রম, কোনো বাস্তব নির্মাণ কাজের ছবি নয়। নিয়োম প্রকল্পের মতো এই স্টেডিয়ামও ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও স্বপ্নের মিলনস্থল—যেখানে বাস্তবতা ও কল্পনা একসঙ্গে ফুটে উঠছে, আর ফুটবলের ভবিষ্যৎ এখনো আঁকা হচ্ছে ভবিষ্যতের ক্যানভাসে।

মন্তব্যসমূহ